গতকাল শুক্রবার ভোররাত থেকে প্রায় ছয় ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে ডুবেছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়ক, অলি-গলি। কোথাও কোথাও পানি উঠেছে কোমরের উপরে। এই পানি সরতে ছয় থেকে ১২ ঘণ্টা লেগে যায়। তবে ঢাকার নিম্নাঞ্চলের এখনো পানি সরেনি। এতে নানামুখী সমস্যায় পড়েছে নগরবাসী।
শুক্রবার যে বৃষ্টি হয়েছে তা অস্বাভাবিক নয়, চলতি বছরেই ঢাকায় এর চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এখন যা পরিস্থিতি তাতে একটানা ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই ঢাকা ডুবে যায়। তারা বলছেন, ঢাকার পানি সরে যাওয়ার পথগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে। ড্রেনগুলোও বলতে গেলে এখন আর তেমন কাজে আসে না। ফলে ঢাকা বৃষ্টিতে ডুববে এটাই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

এই মৌসুমে এর চেয়ে আরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার ভোর ছয়টা থেকে পরবর্তী ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন ঘণ্টা সকাল ছয়টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৬০ মিলিমিটার। আর ছয়টা থেকে দুপর ১২টা পর্যন্ত ১৩০ মিলিমিটার। দুপুর ১২টার পর বৃষ্টি বলতে গেলে থেমে যায়। দপুর ১২টা থেকে পরবর্তী ১৮ ঘণ্টায় মাত্র এক মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় হয়েছে ১৩১ মিলিমিটার বৃষ্টি।
আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির এই তথ্য জানিয়ে বলেন, বর্ষা মৌসুমে এটা কোনো অস্বাভাবিক বৃষ্টি নয়। কারণ শুক্রবারই কক্সবাজারে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৩০৯ মিলিমিটার, সেটা এই বছরে সর্বোচ্চ।
বিজ্ঞাপন
চলতি বছরেরই ২৭ মে রেমালের সময় ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় ২২৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গত বছর এরচেয়েও বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এই স্বাভাবিক বৃষ্টি এ বছর আরও হবে বলে মনে করেন তিনি।

শুক্রবার মূলত সকাল ৬টা থেকে প্রথম তিন ঘণ্টার ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, ধানমন্ডি, গুলশানের মত অভিজাত এলাকাসহ পুরো ঢাকা শহর ডুবে যায়। আর অন্যান্য এলাকার তো কথাই নাই। পরের তিন ঘণ্টায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। ঢাকার প্রধান সড়কসহ অলিতে গলিতে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমে যায়। এই পানি সরতে আবার ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
কেন এই পরিস্থিতি?
এই পরিস্থিতি কেন হলো জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার ৮৫ ভাগ এলাকা কংক্রিটে ঢাকা। ফলে বৃষ্টির পানির রান অফ (গতি) বেড়ে গিয়ে দ্রুত নিচু এলাকায় চলে যায়। কিন্তু নগরে তো আর তেমন ওয়াটার বডি নাই। ফলে এই পানি রাস্তায় জমে। আর ড্রেনেজ সিস্টেম প্রায় অকার্যকর থাকায় ওই পানি ড্রেন দিয়েও বের হতে পারে না। যেটকু পারে তাও আবার ড্রেনের বাইরে গিয়ে সরতে পারে না কারণ। আশপাশের নদী, খাল, জলাভূমি ভরাট হয়ে গেছে। তাই এখন টানা ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই এই শহর ডুবে যায়। কারণ পানি অপসারনের ক্যাপাসিটি নাই।
তিনি বলেন, শহরের মধ্যেও পানি ধারণের কোনো জায়গা নেই। লেক খাল দখল হয়ে গেছে। সিটি কর্পোরেশন কিছু খাল উদ্ধার করলেও তারা উপরের ময়লা শুধু পরিস্কার করে। কিন্তু তলদেশ ভরাটই আছে।

ঢাকায় তিনি ধরনের ড্রেন আছে। বক্স কালভার্ট, রাস্তার পাশের ড্রেন এবং স্টর্ম ড্রেন। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকার সব ধরনের ড্রেনের দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনের। এর আগে ওয়াসার দায়িত্বে স্টর্ম ড্রেনসহ বড় বড় ড্রেন ছিলে। এখন ঢাকা শহরে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ড্রেন আছে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। আর কাগজে কলমে ২৬টি খাল আছে।
আখতার মাহমুদ বলেন, ড্রেনগুলো সলিড বর্জ্যসহ নানা বর্জ্যে প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। আর বক্স কালভার্টগুলো মূলত নতুন আপদ তৈরি করেছে। এর ভিতরে বর্জ্য জমে আগের প্রবাহও নষ্ট করে ফেলেছে।
ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং এবং ডেভেলমন্টের (আইপিডি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা দূর করা আর সম্ভব নয়। পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে কমিয়ে আনা সম্ভব। কারণ আমাদের এখানে এখন ওয়াটার বডি আছে মাত্র মোট আয়তনের দুই- তিন ভাগ। ৪০ ভাগ খালি জায়গা ও সবুজের ক্ষেত্রে আছে মাত্র সব মিলিয়ে ১০ ভাগ। পুরো শহর কংক্রিটে ঢাকা। আর ঢাকার চারাপাশের নদী জলাভূমি, ফ্ল্যাড ফ্লো জোন দখল করে স্থাপনা করা হয়েছে। তাহলে পানি সরবে কোথায়? পানি যে রিচার্জ হয়ে মাটির নিচে চলে যাবে কংক্রিটের কারণে সেই সুযোগও নাই।

তিনি বলেন, ঢাকায় যে বৃষ্টির পানি হয় তা অপসারনের ক্ষমতাই এখন আর ঢাকা শহরের নাই। ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হয়। ড্রেনগুলো আসলে পরিস্কার করা হয় না। আবার নগরবাসীও নানা বর্জ্য ফেলে ড্রেনগুলো বন্ধ করে ফেলেছে।
কী করছে দুই সিটি করপোরেশন?
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০৩টি স্থানকে সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা প্রবণ এলাকা হিসবে চিহ্নিত করছে। তারা এই জলাবদ্ধতা নিরমনে প্রায় ৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে ওয়াসার কাছ থেকে সব ড্রেনের দায়িত্ব নেওয়ার পর এরইমধ্যে দুই সিটি মিলে ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার নিরসন হয়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হোসেন দাবি করেন, আমাদের দিকে খুব বেশি সমস্যা নেই। কিছু এলাকা ছাড়া অধিকাংশ এলাকার পানি দ্রুতই নেমে গেছে। তবে খালগুলো ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবার পরিস্থিতি একটু খারাপ হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিস্কার করে।

তিনি বলেন, নগরবাসীর অসচেতনতার জন্যও এটা হয়েছে। তারা ড্রেনে সব ধরনের ময়লা ফেলে। আর তারা পলিথিন ফেলার কারণে ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়।
আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধয়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের জানান, তারা ১৬১টি জলাবন্ধতা প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করেছেন। সেই সব এলাকায় তারা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন।
তিনি দাবি করেন, আগে শান্তিনগর, নটরডেম কলেজ এলাকা, মতিঝিল, রাজারবাগ, মৌচাক এইসব এলাকায় তিন-চারদিন পানি জমে থাকত, নৌকা চলত। এবার কিন্তু সেরকম হয়নি।

তার মতে, গত বছর সিত্রাং, এবছর রেমালের কারণে ঢাকার আশপাশের নদীর পানি বেড়ে যায় তখন ঢাকা শহরের পানি সরতে পারেনি। এবার আবার উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে এখানকার নদ নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার পানি সরতে পারছে না।
তিনি অভিযোগ করেন, নগরবাসী এমন কিছু নাই যে তারা ড্রেনে ফেলেন না। ফ্রিজও ড্রেনে ফেলে। ফলে ড্রেনগুলো ঠিক মতো কাজ করে না।
তবে তার আশ্বাস, আগামী অর্থ বছরে কিছু কাজ হলে জলাবদ্ধতার অনেকটা নিরসন হবে। তারা আগামী অর্থবছরে ২৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন। সূত্র: ডয়চে ভেলে
/এএস

