শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দুই দশকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বারবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১১ মে ২০২২, ০৮:০৪ এএম

শেয়ার করুন:

দুই দশকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বারবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ বাংলাদেশে ততটা প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। তবে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকে শুরু করে সবশেষ ‘ইয়াস’ পর্যন্ত গত দুই দশকে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়। যার মধ্যে ২০১৭ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ ও ‘রোয়ানু’ ছাড়া সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে খুলনা-সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগপ্রবণ এসব এলাকায় সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে দিতে হবে মনোযোগ। সেগুলো যেন নারী ও শিশুবান্ধব হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও টেকসই বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।


বিজ্ঞাপন


এই এলাকার দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ ইতোমধ্যে নয় দফা দাবি জানানো হয় বেসরকারি সংগঠন লিডার্স ও সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে। গত দুই দশকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে  ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয় সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে।

একইসঙ্গে লবণাক্ততার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা বিশেষ করে নারীদের শরীরে নানা অসুস্থতা বাসা বাঁধছে বলে জানানো হয়।

এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে বেশিরভাগ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকার সুযোগ করে দিতে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মতো ‘একটি বাড়ি একটি শেল্টার’ কার্যক্রম চালুর দাবি জানানো হয়।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে এসব ঘূর্ণিঝড়ে যতটা ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল সেটা সুন্দরবনের কারণে হয়নি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবারই সুন্দরবন বুক চিতিয়ে রক্ষা করে বাংলাদেশকে। প্রতিবারের ঝড়ে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হলেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ এই বনের জন্য। এজন্য সুন্দরবন রক্ষায় উদ্যোগ নিতে জোরালো তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সুন্দরবনকে ধ্বংস করে এমন কোনো উদ্যোগ না নিতে তারা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

 
কোন ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ কোন দিকে ছিল? 
তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলায়।  উপকূলীয় এলাকায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার।

সিডরে রেডক্রসের হিসাবে ১০ হাজার মারা লোক গেছে বলা হলেও সরকারিভাবে ছয় হাজার বলা হয়েছিল। এছাড়াও সিডরে অবকাঠামোগত অনেক ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘরও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

ঘূর্ণিঝড় আইলা ২০০৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। খুলনার, সাতক্ষীরা-বাগেরহাট অঞ্চলের পাশাপাশি পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। খুলনা ও সাতক্ষীরায় ৭১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয় আইলায়। এর আঘাতে প্রাণ হারান দেশের ১৯৩ জন মানুষ।

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু ২০১৬ সালে ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতে আংশিক অঞ্চলে আঘাত হানে৷ ধারণা করা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির৷ রোয়ানুর আঘাতে চট্টগ্রামে ২৬ জনের মৃত্যু হয়।

রোয়ানু চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর হাতিয়ায় বেশি তাণ্ডব চালিয়েছে। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলেও এর প্রভাব ছিল।

২০১৭ সালের ৩১ মে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। এতে আটজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। তবে বিপুল পরিমাণ গাছপালা ও কাঁচাবাড়ি ধ্বংস হয়েছে সে সময়।

২০১৯ সালের ৪ মে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’র প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়, বজ্রপাতে ও বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে দেশে ১৮ জন মারা যায়।

এই ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা, যশোর, বাগেরহাট অঞ্চলে ও বরগুনা, পটুয়াখালীতে আঘাত হানে। এতে বিভিন্ন এলাকায় আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর দেশে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’।  এর তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলা। বিধ্বস্ত হ‌য়ে‌ছে সহস্রাধিক ঘরবা‌ড়ি। ওই অঞ্চল ছাড়াও পটুয়াখালীতেও এটি আঘাত হানে।

২০২০ সালের ২০ মে বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এর আঘাতে বাংলাদেশে সাত জেলায় ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের আঘাত হানার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ঝড়ে খুলনার কয়রা উপজেলায় প্রায় ১৪ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীর বাঁধ ভেঙে নোনা পানিতে বাড়িঘর ও ফসলের জমি প্লাবিত হয়। এতে গাছপালা ও জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়।

২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ভারতে আঘাত হেনেছিল। এর প্রভাবে বাংলাদেশের ১৫টি জেলার ৭৭টি উপজেলা ও ১৩টি পৌরসভায় ক্ষয়ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয় সাতজনের। ইয়াসও ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা-খুলনা-বাগেরহাট জেলায় আঘাত হানে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজের (আইডিএমভিএস)’ পরিচালক ড. দিলারা জাহিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দেশ এখন অনেক এগিয়ে। তবে কিছু জায়গায় অব্যপস্থাপনা রয়েছে। বিশেষ করে পুরোনো আশ্রয়কেন্দ্রগুলো অনেক জায়গায় ব্যবহার উপযোগী নয়। আবার কোথাও রাস্তাঘাট ভালো না। উপযুক্ত জায়গায় এসব শেল্টার তৈরি হয়নি এমন তথ্যও আছে। তবে সরকার নতুন যেসব মাল্টিপারপাস সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করছে সেগুলোর মান ভালো।’

উপকূলীয় এলাকার মানুষের এমন দুর্যোগ থেকে নিরাপদ রাখতে ঝুঁকি নিরূপণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। তিনি বলেন, সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে। গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে।

উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করা সংগঠন লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন মুকার মন্ডল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রতিবছর যেভাবে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে তাতে যদি উপকূলীয় এলাকাকে সুরক্ষিত করা না যায় তাহলে সরকার প্রতিবছর বিপুল অংকের রাজস্ব হারাবে। তাই এই অঞ্চলের মানুষ এবং সম্পদ সুরক্ষিত করতে এখনই মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।’

বিইউ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর