শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বৃষ্টিতে ভাসছে কৃষকের স্বপ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক, জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০ মে ২০২২, ০২:৩১ পিএম

শেয়ার করুন:

বৃষ্টিতে ভাসছে কৃষকের স্বপ্ন

কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি, ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব, ঢলের পানিতে বাঁধ ভেঙে ক্ষেতে পানি ঢুকে পড়াসহ গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ধান চাষিরা ক্ষতগ্রস্থ হয়েছেন। পরে শুরু হয়েছিল শ্রমিক সংকট। এরমধ্যে আবার আরেক বিপদ অশনি। দেশের কোথাও এখনো আঘাত হানার খবর পাওয়া না গেলেও ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে বিভিন্ন এলাকায় ঝরছে বৃষ্টি। আর এতে এখন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা ধান চাষিরা। 

ঢাকা মেইলের যশোর সংবাদদাতার দেওয়া তথ্যানুযায়ী— জেলায় বৃষ্টির পানির ওপরে ভাসছে কেটে রাখা ধান। অন্যদিকে আধা পাকা ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। কষ্টের ধান শেষ মুহূর্তে ঘরে তুলতে না পারায় ক্ষেতে ভেজা ধান আর কৃষকের চোখের পানিতে একাকার। 


বিজ্ঞাপন


সোমবার সকাল ১১টা থেকে বিকাল অবধি যশোরে বৃষ্টিপাত হয়। মঙ্গলবার (১০ মে) সকালের বৃষ্টিতে মাঠে কেটে রাখা, কোথাও বেঁধে রাখা, কোথাও জালি দিয়ে রাখা ধানের ওপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক দীপঙ্কর দাশ জানান, বৃষ্টিতে জেলার বেশ কিছু এলাকায় কাটাধান তলিয়ে গেছে। তবে নতুন করে বৃষ্টি না হলে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। 

তিনি জানান, এরই মধ্যে ৬০ ভাগ ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছেন কৃষক। ৪০ ভাগ ধান ঝুঁকিতে রয়েছে। যশোরে চলতি মৌসুমে এক লাখ ৫৮ হাজার ৮ শ ৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে।

সদর উপজেলার ফুলবাড়ির কৃষক আকতার হোসেন জানান, তারা এখনও ১৫ ভাগ ধান ঘরে তুলতে পারেননি। দুই দিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে কাটা ধান।

বীরনারায়নপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে ধান ক্ষতির মুখে পড়তে পারে ভেবে তারাসহ এলাকার অনেকে আধা পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টায় ছাই ফেলেছে বৃষ্টি। 


বিজ্ঞাপন


চৌগাছার যাত্রাপুর গ্রামের কৃষক আমজাদ আলী জানান, ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে তড়িঘড়ি করে ধান কেটে ঘরে তুলেছি। তবে প্রতিবেশিদের অনেকের কাটা ধান বৃষ্টির পানিতে ভাসছে। 

তিনি বলেন, অনেকে চোখের পানি ফেলছেন। বলছেন ধানে শ্রমিকের ঘামের দামও উঠবে না।
paddy jashoreতবে যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক দীপঙ্কর দাশ বলেন, সব উপজেলায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন কৃষি কর্মকর্তারা। ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র জানা যাবে দু-একদিন পর। তিনি আরও বলেন, এখনও মাথায় হাত দেওয়ার মতো ক্ষতি হয়নি। আর বৃষ্টিতে ভেজা ক্ষেতের কাটাধান ডাঙায় তুলে নিতে হবে। তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় চাষিদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

গোপালগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, জেলায় উৎপাদিত ধানের একটি বড় অংশ আসে চান্দার বিল নামক একটি বিল থেকে। এই চান্দার বিলটি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার উজানী, ননীক্ষীর, জলিরপাড়, কাশালিয়া, সদর উপজেলার সাতপাড় ও কাশিয়ানী উপজেলার হাতিয়াড়া  ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চান্দার বিলের বেশিরভাগ অংশ পড়েছে উজানী ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নে বড় বিল নামে আরও একটি বিল রয়েছে। এক সময়  এই বিলটিও চান্দার বিলের অংশ ছিল। বিল বেষ্টিত এসব এলাকার ৯৫ ভাগ মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস ধান উৎপাদন। প্রায় ১৫ হাজার পরিবার এসব বিলে এক ফসলি বোরো ধান উৎপাদন করে সারা বছর তাদের সংসার চালায়। 

এ চান্দার বিল ও বড় বিলের সঙ্গে সরাসরি  সংযোগ রয়েছে এমবিআর ক্যানেলের। বিগত কয়েক বছর এমবিআর ক্যানেল থেকে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় এই এলাকার বিলের কৃষি জমিগুলো। প্রতিবছর জোয়ারের পানি প্রবেশের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তবে এবার অশনির প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের পানি মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপদের সম্মুখীন হয়েছে এলাকার মানুষ। 

জোয়ারের পানি মাত্রাতিরিক্তভাবে প্রবেশের ফলে তলিয়ে গেছে ওই সব এলাকার প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমির ধান। পানি বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ খেতের কাঁচা ও আধা পাকা ধান কাটতে শুরু করেছিলেন অসহায় কৃষকেরা। তবে ধান কাটতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের।
paddy jashoreএকদিকে বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে জমির ধান নষ্ট হচ্ছে, অপর দিকে  সংকট দেখা দিয়েছে ধান কাটা শ্রমিকেরও। প্রতি বছর ফরিদপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বাগেরহাটসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে শ্রমিক ধান কাটতে আসলেও এ বছর তাদের দেখা মিলছে না। যে শ্রমিক এসেছে তাদের দ্বিগুণেরও বেশি মজুরি দিতে এমন অবস্থায় দিশেহারা কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। 

গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. অরবিন্দু কুমার রায় জানান, চান্দার বিলের ওই সব এলাকার জমি নিচু, একবার পানি উঠে গেলে সহজে নামে না। হারভেস্টার মেশিনও সেখানে চলে না। জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া শ্রমিক সংকট সমাধানের জন্যও চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে সাতক্ষীরা জেলা পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, অনেকে ধান কাটলেও বাড়িতে তোলার সময় পাননি। মাঠের মধ্যে বৃষ্টিতে সব ভিজে গেছে। ধানগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। 

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলার সাত উপজেলায় এ বছর জমিতে বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭৬ হাজার হেক্টর। তবে বেরো ধান চাষ হয়েছে ৭৭ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে। এক হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে। এ আবাদের মধ্যে ৩০ ভাগ হাইব্রিড, ৫০ ভাগ জমিতে ২৮ জাতের ধান, বাকি জমিতে বিরি-৬৩, ৬৭, ৮১, ৮৪ ও বিনা-১০ জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন হয়েছে চার টন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপপরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলায় জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। বর্তমানে সাতক্ষীরা সদর, তালা ও কলারোয়া উপজেলায় কিছু জমির ধান জমিতে রয়েছে। জেলায় বর্তমানে ৮৫ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে ১৫ ভাগ। প্রায় ১১ হাজার ৫৮৩ হেক্টর জমির ধান রয়েছে জমিতে।
paddy jashoreতিনি বলেন, সব চাষির ধান কেটে ফেলার জন্য আগেই বলা হয়েছিল। তবে অনেকেই এখনো জমিতে ধান রেখেছেন। তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে খামারে ধান তুলে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। জেলার সব কৃষি কর্মকর্তা, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করে কর্মস্থলে থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবমুক্ত হওয়ার পর পরবর্তী নির্দেশনা পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।

অশনির আশঙ্কায় আধপাকা ধান কেটে রেখেছিলেন বাগেরহাটের কৃষকরা। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি অনেকের। সোমবার সকাল থেকেই জেলার সবগুলো উপজেলায় বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে বিপাকে পড়েছেন তারা।

চাষিরা বলেন, ‘আগাম ধান কেটেও শেষ রক্ষা হলো না। বাড়ি আনার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।’ 

স্থানীয়রা জানান, এ বছর বোরো ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা স্বস্তিতে ছিলেন। হঠাৎ ঝড়ে পরিস্থিতিতে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হলেন অনেকে। 

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাগেরহাটের উপ-পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় অশনির পূর্বাভাস পাওয়ার পরপরই প্রতিটা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন মাধ্যমে কৃষকদেরকে খবর পৌছে দেওয়া হয়েছে। জেলার প্রায় ৯২% ধান কেটে ঘরে তুলেছে কৃষকরা। যদি এ বৃষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি না পায় তাহলে বাকি ৮% ধানেরও ক্ষতি হবে না।
PADDY SIRAJGONJ
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাদা জানান, জেলার তাড়াশ উপজেলায় ফসলের মাঠগুলোতে পানি জমে পাকা ধান নষ্ট হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রবল বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাওয়া ধান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন উপজেলার কৃষকরা। ফসল রক্ষায় অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেও এই বৃষ্টিতে মিলছে না ধান কাটা শ্রমিক। ফলে ক্ষেতেই পঁচে যাচ্ছে ধান।

কৃষকদের অভিযোগ, অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ-কালভাটের, বন্ধ খাল-নালা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে পানি নিস্কাশন হয় না। তাই বৃষ্টি হলে পানি নিস্কাশনের বাধাগ্রস্ত হয়। এতে করে ফসলি মাঠগুলো ডুবে কৃষকের সর্বনাশ হচ্ছে প্রতিবছর। বিশেষ করে, উপজেলার দেশীগ্রাম ইউনিয়নের গুড়পিপুল, আড়ংগাইল, মাধাইনগর ইউনিয়নের ভাদাস, সেরাজপু, মালশিন, গুড়মা, তাড়াশ পৌর এলাকার কোহিত, আসানবাড়ি, বারুহাস ইউনিয়নের বিনসাড়া, বস্তুলসহ বিভিন্ন গ্রামের ফসলি মাঠে বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে ধান। অনেক ক্ষেতে ধান পঁচে গিয়ে চারা বের হয়ে গেছে।

এ বছর এক বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। বর্তমানে শ্রমিক খরচ আরও প্রায় সাত হাজার টাকা বেড়ে নয় হাজারে ঠেকছে।

বারুহাস ইউনিয়নের বিনসাড়া গ্রামের শিক্ষক আজাদ শেখ বলেন, কৃষকের পাকা ধান পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছে, অর্ধেক ভাগেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে আবার অশনির কারণে অবিরাম বৃষ্টিপাতে কৃষকদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
PADDY SIRAJGONJতিনি আরও জানান, পাবনা থেকে কৃষি শ্রমিকেরা তাড়াশ উপজেলার বিভিন্ন গৃহস্থের বাড়ি থেকে ধান কাটতেন। কিন্তু এবছর তারা অজ্ঞাত কারণে এখনও অধিকাংশ গৃহস্থের বাড়িতে আসেননি। তাই শ্রমিক সংকট দেখা দেয়।

তাড়াশ পৌর সদরের কৃষি শ্রমিক মহির উদ্দিন বলেন, ‘হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় মাঠের ধানগুলো পানিতে ডুবে গেছে। এখন প্রতি বিঘা জমিতে চার থেকে পাঁচজন শ্রমিক বেশি লাগবে। আগে যেখানে এক বিঘা জমিতে খরচ হতো তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। সেখানে এখন অতিরিক্ত খরচসহ প্রায় সাত হাজার থেকে নয় হাজার টাকা। শুধু তাই কিছু এলাকায় অর্ধেক জমিওয়ালার অর্ধেক শ্রমিকের তবুও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এখন তো বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করার মতো শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না।

তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার লুনা বলেন, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২২ হাজার ৩১৫ হেক্টর। কিন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্জিত হয়েছে ২২ হাজার ৩৬০ হেক্টর।

তিনি আরও বলেন, চলতি বোরো মৌসুমের শুরু থেকে কৃষি বিভাগের মাঠকর্মীসহ সকল স্তরের কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা দিক নির্দেশনা দিয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করেছেন। মাঠের শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটা নিয়ে কৃষকরা একটু সমস্যায় পড়েছেন।

এএ/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর